সকল মেনু

মুক্তিযোদ্ধা মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগমের যুদ্ধকথা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগম সংগঠক, নেতৃত্ব দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। লিখেছেন রীতা ভৌমিক

যুদ্ধক্ষেত্রেও গিয়েছি: অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই মতিয়া চৌধুরী সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতির সদস্য ছিলেন। ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত মতিয়া চৌধুরী ১৯৭০ ও ’৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, যোগাযোগ এবং আহতদের শুশ্রূষার সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে মতিয়া চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে বাংলাদেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য আমরাও রমনা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিকে দাঁড়িয়েছিলাম। বলতে গেলে, আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এবং রাজনৈতিক সচেতন কর্মী হিসেবে এ সভায় যোগ দিয়েছিলাম। আমি ভাষণ শোনার জন্য যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে মঞ্চ ছিল অনেক দূরে। বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মঞ্চে উঠলেন, বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন, উনার বক্তব্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত শ্রোতামণ্ডলী যেন নয়, পুরো বাংলাদেশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনল। পৃথিবীতে যেসব ভাষণ দেশ-জাতি ও সমাজকে উজ্জীবিত করে, ৭ মার্চের ভাষণ তার অন্যতম। সেদিন মেয়েরাও ভাষণ শুনতে বেরিয়ে এসেছিলেন। যদিও তখন সাধারণ নারীরা সেভাবে এত বেশি সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতেন না। অবশ্য একেবারে রাজনীতি সচেতন ছিলেন না বলাও ভুল হবে, তা না হলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হলো কীভাবে? এ জনসভায় শুধু রাজনৈতিক কর্মী নয়, সেদিন বাঙালি প্রত্যেকটি মানুষ লড়াকু রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কর্মী হয়ে গিয়েছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘরে ঘরে আক্রমণ করেছিল। রাজনৈতিক কর্মী তো বটেই, সেদিন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, আমাদের স্বাধীন দেশ ছাড়া বিকল্প চিন্তার আর সুযোগ নেই। ৩০ মার্চ পার্টির অন্যান্য নেতাকর্মী যেমন বজলুর রহমান, ডা. সারোয়ার আলী, মনিরা আক্তার, মতিউর রহমান, ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্নাসহ ঢাকা ছেড়েছিলাম। ঢাকার খিলগাঁও হয়ে মেরাইদ, বেরাইদ, কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জের ঢাকি, ইটনা, অষ্টগ্রাম, টোকে যাই। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পিরিজপুর গ্রামে মতিউর রহমানের (প্রথম আলো সম্পাদক) এক বিধবা নানির বাড়িতে আশ্রয় নিই। পুরো দলটিই কিছুদিন ওখানে অবস্থান করি। কিন্তু আমাদের পরিচয় বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

মতিয়া চৌধুরী বলেন, আমার পরিচয় লুকিয়ে রাখার শতচেষ্টা সত্ত্বেও ওই বাড়িতে ‘অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী আছেন’—এলাকায় এই খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়। আমাকে দেখতে এলাকার লোকজন বাড়িতে খুব ভিড় করছিল। সুতরাং আমাদের দলটি ওই বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ মনে করছিল না। প্রথমেই আমাকে সেখান থেকে আগরতলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। নৌকায় সুনামগঞ্জের হাওর পার হয়ে তারপর বালাট বর্ডার দিয়ে ভারতের মেঘালয় গেলাম। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করব। মেঘালয় যাওয়ার এই যে বিস্তীর্ণ দীর্ঘ পথ, এই পথে যারা রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন— আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক জনতা পার্টি এমনকি নারী সংগঠন; ওই সময় হাতেগোনা কয়েকজন রাজাকার বাদে সবাই মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্র তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছিলেন। সেটা মানসিকভাবে। সেটা অস্ত্র নিয়ে। সেটা সম্মুখ সমরে বা সেই সমরের জোগানদার হিসেবে। যে মা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করে দিয়েছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি যে বোন সম্ভ্র্রম হারিয়েছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়েছেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি আমি মনে করি, আমাদের নিয়ে যাওয়ার কিছু ছিল না, হয়তো কিছু খাবার রান্না করে আমাদের সঙ্গে পথ চলেছেন তারাও। আসলে সবাই জানত, আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। মেঘালয় থেকে গৌহাটি, আসাম হয়ে আগরতলায় পৌঁছলাম। ওখানে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক লীগ—সবাইকে পাই। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রগতিবাদী সব সংগঠকের নারী-পুরুষ আগরতলা ক্রাফটস হোস্টেলকে আমাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। এখানে সেলিনা বানু, মালেকা বেগম, ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, ফরিদা আক্তার, আয়শা খানম, আমিসহ বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হই। ক্রাফটস হোস্টেল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জায়গা। আমরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছি। নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। মাঝেমধ্যে ফিল্ড হসপিটালে গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি। পাশাপাশি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

মাঝেমধ্যে সম্মুখযুদ্ধেও গিয়েছি। সেগুলো ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ নয়, যেমন বক্সনগর; এসব জায়গায় আমরা গেছি। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দুই-তিন দিন আমি যুদ্ধক্ষেত্রেও গিয়েছি। মীর শওকতের সঙ্গে কিছুদিন ডাউকির দিকে গিয়েছি। কলকাতা গিয়েছি। কলকাতার দিকেও আরেকটা সেক্টর ছিল। সেখান থেকে দিল্লিতে গিয়েছি সহায়ক সমিতির কনফারেন্সে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কনফারেন্স। সেখানে আমরা বাংলাদেশের বক্তব্য শরণার্থী হিসেবে তুলে ধরেছি। যেখানে যতটুকু করা সম্ভব, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একবিন্দু শিশির হলেও সেখানে ছুটে গেছি। সেখানে আমাদের বক্তব্য নিয়ে যাওয়া উচিত মনে করতাম।

শুধু তাই নয়, মতিয়া চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট এলাকায়ও যান। শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা হাসপাতালে নার্সিং করতেন। ছোট ছোট মিটিং হতো সেখানে তাদের উজ্জীবিত করতেন। শেষের দিকে যশোরে গিয়ে মিটিং করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার ক্ষেত্রে যখন যেখানে দরকার পড়েছে, যখন যেখানে পাঠানো হয়েছে সেখানেই গিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না, খাবার তৈরি, সেবাশুশ্রূষা করেছেন। আগরতলা হাসপাতালে নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ভারতে পৌঁছে তার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছিল আগরতলা। এ প্রসঙ্গে মতিয়া চৌধুরী বলেন, একপর্যায়ে আয়শা খানম, মুনিরা আগরতলায় থেকে কাজ করেন। আমি চলে গেলাম কলকাতায়। কলকাতায় থাকতে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম এবং আমি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ক্যাম্পে, বশিরহাট, টেট্রা এসব ক্যাম্পে গিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছি। স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণও ছিল। আগরতলা, বশিরহাটেও কিছুটা অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কোনো সময় সাত দিন, কোনো সময় তিন দিন। আরেকটা বিষয় ছিল নার্সিং। আহত মুক্তিযোদ্ধারা এলে তাদের শুশ্রূষা করা। আগরতলা মাঠে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওখানে সহায়ক সমিতির বিভিন্ন মিটিংয়ে আমি বক্তৃতা দিই।

একাত্তরে ভারতে শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা গিয়েছিলাম। ভারতের মানুষ আমাদের জন্য যে ত্যাগ করেছেন, তা অপরিসীম। আগরতলা অর্থনৈতিকভাবে তত উন্নত ছিল না। কিন্তু ওখানকার মানুষ যেভাবে আমাদের সঙ্গে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, এর তুলনা হয় না। এ ছাড়া ভারতীয় নারী ফেডারেশনের আমন্ত্রণে তাদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আর আমি দিল্লিতে যোগ দিই। সেখানে আমরা ভারতের প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরির সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পাই। পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের সামনে অস্ট্রেলীয় জনগণ অনশন করেন। তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় মেয়েদের সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্ব গণতান্ত্রিক নারী ফেডারেশনের নেত্রী ফ্রিডা ব্রাউন, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম এবং আমিও অনশনে যোগ দিই। কলকাতা থেকে শুরু করে জলপাইগুড়ি, পানিপথ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে প্রচারণা চালাই। মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, পাশবিকতা, স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে সারা ভারতবর্ষে প্রচার আন্দোলন চালিয়েছি। সংগঠিত উদ্যোগে পরিচালিত এ কাজের ব্যাপক শুভকর প্রভাব পড়েছিল ভারতীয় নারী সমাজের ওপর। ভারতীয় নারী ফেডারেশনের নেতা অরুণা আসফ আলী, রেণু চক্রবর্তী, বিমলা ফারুকী, গীতা মুখার্জি, বাণী দাশগুপ্ত, ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত (যোশি), বিদ্যা মুন্সী, নিবেদিতা নাগসহ বহু নারী আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আমাদের চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেমিনার, সভা-প্রচার-প্রচারণা

করেছি: মালেকা বেগম

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের আয়োজনে বায়তুল মোকাররমে সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একটি সভা ও মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সভানেত্রী সুফিয়া কামাল স্বাধিকার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব স্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সংগঠনের সহসভানেত্রী মিসেস সারা আলী, অধ্যাপিকা সেলিনা বাহার জামান, নার্স কণিকা ভট্টাচার্য, মনোয়ারা বিবি এবং আহ্বায়িকা মালেকা বেগম স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ঘর থেকে শুরু করতে হবে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও প্রতিরোধ আন্দোলন। আমরা নারীসমাজ বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে উদ্দীপ্ত হই। এরিই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডি গার্লস কলেজ মাঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পলাশী, জিগাতলা, রায়েরবাজার, কলাবাগান, গোপীবাগ, সুত্রাপুর ও গেন্ডারিয়ায় ছাত্রী ও নারীসমাজ একত্রিত হয়ে কুচকাওয়াজে অংশ নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব সম্পর্কে মালেকা বেগম বলেন, কবি সুফিয়া খালাম্মা, অন্যান্য নারী নেত্রী ও আমি পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় ঝটিকা সফর করি। উদ্দেশ্য মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার বার্তা পৌঁছে দেওয়া। নারীসমাজকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করা। আমাদের শেষ সমাবেশ ছিল চট্টগ্রাম। ১৮ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত সভা, মিছিল, সমাবেশ করি। আমাদের মিছিল-সমাবেশের ছবি সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যায়। ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ সমাবেশে ভাষণ দেন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সভানেত্রী সুফিয়া কামাল ও আমি। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এ সভায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীসমাজকে জঙ্গি ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

মালেকা বেগম একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে শ্বশুরবাড়ি ঢাকার বংশালে অবস্থান করছিলেন। ১৪ এপ্রিলের দিকে স্বামী মতিউর রহমানের নানাশ্বশুর বাড়ি কাপাসিয়া যান। তাদের সঙ্গে যান ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বিশিষ্ট সাংবাদিক বজলুর রহমান। ঢাকা থেকে এরই মধ্যে এসেছিলেন মহিলা পরিষদ নেত্রী আয়শা খানম, রোকেয়া কবীর। সেখান থেকে নানা পথ পেরিয়ে আগরতলার ক্রাফটস হোস্টেলের ক্যাম্পে পৌঁছেন মে মাসে। সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকা, খবর, বুলেটিন এবং শরণার্থীদের কাছ থেকে নারীদের ওপর চালানো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের তথ্য সংগ্রহ করে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বুকলেট লেখার কাজ সম্পন্ন করেন।

ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রগতিবাদী সব সংগঠকের নারী-পুরুষ আগরতলা ক্রাফটস হোস্টেলকে তাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলেন। এখানে সেলিনা বানু, মতিয়া চৌধুরী, আয়শা খানম, ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, ফরিদা আক্তার, মুনিরা আক্তার, রোকেয়া বেগম, মিনি মর্জিনা, মিসেস রউফ, ঢাকার চারুকলার লাইব্রেরিয়ান জাহানারা বেগম, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি কলেজের অধ্যাপিকা লক্ষ্মী রানী আইচ, মালেকা বেগমসহ অনেকেই ছিলেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক কাজ করেন মালেকা বেগম।

মালেকা বেগম বলেন, জিভি হাসপাতালে ফার্স্ট এইড ট্রেনিং, ক্যাম্পে ক্যাম্পে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করি। পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার থেকে উদ্ধার পাওয়া নির্যাতিত মেয়েদের হাসপাতালে এনে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। এ ক্যাম্পের বাইরেও মহিলা পরিষদের নেত্রী মনোরমা বসু, হেনা দাস, শান্তি দত্তের সঙ্গে নারীদের সংগঠিত করার কাজ করেছি। যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় মেয়েদের সমর্থন আদায়ের জন্য কলকাতা থেকে শুরু করে জলপাইগুড়ি, পানিপথ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে সভা করি। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। একাত্তরের ১৭ জুন ভারতের বনগাঁওয়ে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন, মহিলা সমিতি এবং মহিলা পরিষদের হয়ে যৌথ সভা করি।

তিনি আরও বলেন, ভারতের নারী ফেডারেশনের সহযোগিতায় ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে আমি মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, পাশবিকতা, স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে ভারতবর্ষে প্রচার আন্দোলন চালিয়ে যাই। সংগঠিত উদ্যোগে পরিচালিত এ কাজের ব্যাপক প্রভাব পড়ে ভারতীয় নারীসমাজের ওপর। তারা আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। এরই অংশ হিসেবে তারা আমাদের সমব্যথী হয়ে ভারতসহ বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করা এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করেন। ভারতীয় নারী ফেডারেশনের নেতা অরুণা আসফ আলী, রেণু চক্রবর্তী, বিমলা ফারুকী, গীতা মুখার্জি, বাণী দাশগুপ্ত, ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত (যোশি), বিদ্যা মুন্সী, নিবেদিতা নাগসহ বহু নারী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেমিনার, সভা ও প্রচার-প্রচারণার কাজে বিশেষভাবে অংশ নেন। তাদের আহ্বানে বিশ্ব গণতান্ত্রিক নারী ফেডারেশনের (ডব্লিউ-আইডিএফ) নেত্রী ফ্রিডা ব্রাউন দিল্লিতে আসেন জুলাই মাসে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সংগঠন মহিলা পরিষদকে সমর্থন জানান। ভারতীয় নারী ফেডারেশনের আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং আমি দিল্লি যাই। অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের সামনে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অস্ট্রেলীয় জনগণের সঙ্গে বিশ্ব গণতান্ত্রিক নারী ফেডারেশনের নেত্রী ফ্রিডা ব্রাউন, ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে আমিও অনশনে যোগ দিই। বিশ্ব বিবেকের প্রতি আবেদন জানাই… পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত এ কাজ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর খুনিদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে তাদের প্রকাশ্য গণহত্যার প্রকৃতি এতটাই ভয়ানক ও বীভৎস যে, কোনো ধরনের নিন্দা জানানোর মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে এ অপরাধের ক্ষত মোচন সম্ভব নয়। এ অপরাধ থামাতে, এই কসাইদের ঠেকাতে বাংলাদেশের জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। স্বাধীনতার জন্য একটি মরণপণ লড়াই শুরু করে। ‘আমাদের স্বাধীনতা দাও অথবা মৃত্যু দাও’—প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এই একটি স্লোগান একই সুরে বেজে ওঠে। …ব্যাপক গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি আমাদের নারীদের ওপর চালানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও চরম শারীরিক নির্যাতন।… সেখানে আমরা ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পাই। এখানেই আমরা থেমে থাকি না। ১২ জুলাই মহিলা পরিষদ থেকে বিশ্বের নারীসমাজের প্রতি আবেদন জানাই ‘বাংলার নারীদের বাঁচান’ শিরোনামে।

পাকিস্তানি বাহিনীর নারী নির্যাতনের ওপর জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি দিই। বিবৃতিতে উল্লেখ করি, ‘বাংলাদেশের নারীদের চরম নির্যাতিত অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের এবং পাকিস্তানি সেনাদের এই নারী অত্যাচারের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’

৪ অক্টোবর বাংলাদেশের নারীদের ওপর পাকিস্তানি ফৌজের অত্যাচারের ঘটনা তদন্ত করার জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘের (জাতিসংঘ) প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে আবেদন জানিয়েছিলেন মালেকা বেগম। নভেম্বরের শেষদিকে আগরতলায় শরণার্থীদের পাশে থেকে কাজ করেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

TOP