মঈদুল হাসানের
মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় সংস্করণ সপ্তম মুদ্রণ হয়। আমার মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জনের জন্য এ গ্রন্থটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে—নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ডায়েরি, স্মৃতিচারণ, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, পরবর্তীকালে নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ও অপরাপর তথ্যসূত্র। এগুলো ব্যবহার করে বইটিকে দাঁড় করানো হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই গ্রন্থের যুক্তি বা বক্তব্যকে খণ্ডন করে কোনো প্রকাশনা বের হয়নি। তাই প্রামাণ্য দলিলসহ বইটিতে সন্নিবেশিত তথ্যগুলোকে নির্ভরযোগ্য বলেই মনে করেন অধিকাংশ ব্যক্তি।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বইটির শুরু। যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরাসরি আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। খুব সংক্ষেপে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা করে মার্চ মাসে চলে যান লেখক মঈদুল হাসান। ২৫ মার্চ থেকে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয় গ্রন্থটিতে। ২৫ মার্চের একটি বড় ধরনের বিতর্কের জায়গা ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’। এ বইটিতেও খুব বিস্তারিত বলা নেই। তবু বলা আছে, পাকিস্তানি হামলার শেষ পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সুসংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিভিন্নভাবে অনেকে বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করেন। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলা আছে বইটিতে। পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীনের দায়িত্ব ছিল বেশি। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছলেও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হতে আরও বিলম্ব হয়। এই বিলম্বের মাঝখানে কিছু ঘটনা ঘটে। যে ঘটনাগুলো পরবর্তী সময় অস্থায়ী সরকারের মধ্যে দ্বিধা, অবিশ্বাস ও বিভক্তির জন্ম দেয়। যেগুলো আরও অনেক অবনতি হতে পারত।
মার্চের প্রথম দিকে ভারতের হাইকমিশনের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ হয়। এখানে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বলা হয়, তিনি বুঝলেন ‘ভারতের সঙ্গে কোনো ব্যবস্থাই নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।’ যার মানে, সেখানে আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শরণার্থীরা বিপুলভাবে সেখানে আশ্রয় নিতে থাকে। তাদের পুনর্বাসন ও যুদ্ধে ভারতীয় সাহায্যের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে কারণে তাজউদ্দীন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বৈঠক করেন। এই সময় পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে অন্য নেতৃবৃন্দের কোনো যোগাযোগ বা সরকার গঠন হয়নি। এ পর্যায়ে মঈদুল হাসান বইটিতে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন—বৈঠককালীন তাজউদ্দীন আহমদ কোনো সরকারের প্রতিনিধিত্ব না করলে বৈঠক সফল হতো না। তাই তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। পরবর্তী সময়ে অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।
১০ ও ১১ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়। কিন্তু সরকারে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব করার বৈধতা নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেকে বিতর্ক তোলেন। পরবর্তীকালে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন ‘মুজিব বাহিনী’র সঙ্গে তাজউদ্দীনের বিরোধ বাধে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা মূলত তিনটি স্তর দেখি। প্রথমত, অস্থায়ী সরকার গঠন। দ্বিতীয়ত, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল ইসলাম খান নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী গঠন। তৃতীয়ত, দেশের ভেতরে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ বাহিনী; যার মধ্যে টাঙ্গাইল ও শিবপুর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ তিনটি ধারার মধ্যে প্রথম দুটি কখনো কখনো অনেক সহিংস রূপ নেয়। দেশের ভেতরে মাঝেমধ্যেই এই ঘটনা ঘটতে থাকে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন আরেক অংশ এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে দলের ভেতর থেকে প্রায় সময়ই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার বিস্তারিত বিবরণ বইটিতে আছে। যার বিরোধিতা করে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী। এ বাহিনী ভারতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘র’ সরাসরি তত্ত্বাবধান করত। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক জেনারেল ওবাং-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তিব্বতের প্রশিক্ষণে তাকে দেখা যায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও এর নেতৃত্ব নিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতি দেখা দেয়।
তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থি একটি দল সক্রিয় ছিল। এই দুইয়ের কোনো না কোনো দিক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামীপন্থি কয়েকজন নেতৃবৃন্দ ও নির্বাচিত সংসদ সদস্য তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়ে সার্কুলার দিয়েছিল। বইয়ের ২৩, ৮৬ ও ৯১ পৃষ্ঠায় এ বিষয় আলোচিত হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের অংশগ্রহণ। ঘুরেফিরে খুব একটা বেশি আলোচিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুদ্ধ যত বেশি গেরিলা রূপ নিচ্ছিল, বামপন্থি সংগঠন ও কর্মীদের অংশগ্রহণ তত বেশি বাড়ছিল। দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন, কার্যপদ্ধতিতে মিল থাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের চেয়ে বাম কর্মীরা যুদ্ধে অধিক সক্রিয় ছিল। কিন্তু যুদ্ধে বামপন্থিদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে ভারত সরকার থেকে শুরু করে মুজিব বাহিনী পর্যন্ত সবার শক্তিশালী প্রতিরোধ ছিল। বইয়ের পৃষ্ঠা ২২-এ বলা হয়েছে, ‘বিদ্রোহী ও বামপন্থিদের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথমদিকে ছিল অতিশয় প্রবল।’ বামপন্থিদের মধ্যে এক অংশ পিকিংপন্থি নামে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকার কারণে কিছু পিকিংপন্থি নেতা নিষ্ক্রিয় ও যুদ্ধবিরোধী কথা বলে। এ ছাড়া একটা বিশাল অংশের কর্মী ও নেতৃবৃন্দ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশে ও ভারতে চেষ্টা করতে থাকেন।
হায়দার আকবর খান রনো, সিরাজ শিকদারসহ একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানী সীমান্ত অতিক্রমের পর ভারত সরকারের আশ্রয়ে ছিলেন। পরে ভাসানীকে নিয়ে তাজউদ্দীনের একটি মুক্তিফ্রন্ট করার ইচ্ছা ছিল, যা পরে ‘জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ আকারে স্থাপিত হয়। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ভারতের প্রথমেই কোনো স্পষ্ট অবস্থান ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার স্বার্থের অনুকূলে হবে কি না, তা নিয়েও ভারতের কেন্দ্রে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল। ভারতের দক্ষিণপন্থিরা চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ মীমাংসা করুক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। যে কারণে ভারতও সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সোভিয়েত ও ভারতের মিত্রতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসে। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের সমর্থন দেওয়ার একটি অনিবার্য পূর্বশর্ত ছিল—মস্কোপন্থি বামেরা এখানে কী ভূমিকা পালন করছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আওয়ামীপন্থিরা বামদের মুক্তিযুদ্ধের তালিকা থেকে বাধা দিয়েছিল। মস্কোপন্থি
ন্যাপ, সিপিবি, ইউনিয়ন সবাই প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। এর কিছু সামান্য তথ্য মুসতারী শফির লেখা গ্রন্থেও পাওয়া যায়।
ভাসানীকে নিয়ে ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করার অন্যতম কারণ ছিল বামপন্থি নেতাদের আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা। বিশেষত মস্কোপন্থিদের তুলে ধরা, যাতে করে রাশিয়ার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। মোশতাক ও মুজিব বাহিনী এই পরিষদের বিরুদ্ধে প্রবল বাধা তৈরি করে। কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার কারণে তাজউদ্দীন এই কাজে সফল হয়। তাই সেপ্টেম্বরের পর থেকে বামপন্থি কর্মীরা আরও সক্রিয়ভাবে ও প্রকাশ্যে যুক্ত হতে শুরু করেন।
তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তার ভয়াবহ অধঃপতন হতে থাকে। একপর্যায়ে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের কোনো একসময় তার প্রাণনাশের একটি হামলা হয়েছিল। বইয়ে বলা হয়েছে, ‘মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয়দানকারী এক যুবক আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে হাজির হয়ে জানায় যে, তাদের এক নেতা তাজউদ্দীনের প্রাণ সংহারের প্রয়োজন উল্লেখ করা মাত্র স্বেচ্ছায় সে এখানে এসেছে, যাতে তাজউদ্দীনের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাজউদ্দীন তখন অফিসে সম্পূর্ণ একা।’ সে সময়ে এ ধরনের একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।
তাজউদ্দীনসহ অনেকে চেয়েছিলেন সর্বদলীয় জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করতে। কিন্তু সেটা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি হিসেবেও খুব বেশি কার্যকর থাকতে পারেনি। বিভিন্ন ধারা ও শক্তিকে একত্রীভূত করে যে রূপ দেওয়া সম্ভব হলো না, তার ফল আমরা স্বাধীনতার পর পাই।
সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত কীভাবে যুক্ত হলো, তার আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকা, ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের অবস্থা সব প্রকাশ হয়েছে। এপ্রিলে পাকিস্তান গোটা বাংলাদেশ দখল করল। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এসে তারা নমনীয় হয়। পরে পাকিস্তান ফেডারেল কাঠামোর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাকিস্তান রক্ষায় চেষ্টা করে। তাদের সব ভূমিকা, ভারতের কেন্দ্র, গোয়েন্দা সংস্থা ও দক্ষিণ অংশ, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সভাগুলো যা হচ্ছে প্রভৃতির মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য, দ্বিধা চলছে সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ এ গ্রন্থটিতে আমরা পাই।
সেপ্টেম্বরের পর থেকেই যুদ্ধ একটা পরিষ্কার আকার গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে ভারত যুক্ত হয়। স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের মধ্যেই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এর মধ্যে জাতিসংঘের ভূমিকা, চীন কী কারণে যুক্ত হলো না, সপ্তম নৌবহর প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় বইটিতে।
১৬ ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলেও অস্থায়ী সরকার দেশে আসে ২২ ডিসেম্বর। এটা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন আছে। স্বাধীন হলেও কেন এতদিন পর অস্থায়ী সরকার দেশে আসে? এর কিছুটা সূত্র এখানে পাওয়া যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরের বর্ণনাও এখানে পাওয়া যায়। কীভাবে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হওয়ার পর হঠাৎ দেশে ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ তৈরি হয়। কীভাবে তারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করল, যা মুক্তিযুদ্ধের উপরে গেল। আরেকটি বিষয় বলা হয়েছে, ‘১৬ ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পর এই বাহিনীর উৎপত্তি ঘটে বলেই অচিরেই ঢাকাবাসীর কাছে এরা ‘Sixteenth Division’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কালক্ষেপণ না করে এদেরই একটি অংশ অন্যের গাড়ি, বাড়ি, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর বিষয় সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। সুযোগসন্ধানী ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে।’ ২১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এই গুরুতর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। একটু পরই ২২০নং পৃষ্ঠায় আবার বলা হয়, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের সূত্রপাত হয়, যখন দৃশ্যত কিছু শিখ অফিসার এবং তাদের অধীনস্থ সেনা যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এবং খুলনার ক্যান্টনমেন্ট ও শিল্প এলাকায় লুটপাট শুরু করে।’ বাংলাদেশ সরকার তখনো দেশে আসেনি। তার কারণ ও ব্যাখ্যার কিছুটা বইটিতে মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘ভারতের প্রধান কর্মকর্তা বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত। ভারতের প্রধান কর্মকর্তা ডি পি ধর সপ্তম নৌবহর উদ্ভূত জরুরি পরিস্থিতির জন্য ১১ ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি অবধি মস্কোয় অবস্থান করেছিলেন। ১৮ ডিসেম্বরে ডি পি ধর কলকাতা এসে পৌঁছাবার পর ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে তার আলোচনা চলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অনুরোধ ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে।’ এ কারণে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রিসভাকে থাকতে হয় এবং ২২ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় ফেরত আসে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন নিয়ে শেষ দিকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আলোচনা চলছিল। যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখন নিশ্চিত সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকে রাখার আর কোনো যুক্তি ছিল না। তখন তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট। এখানে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন সরকারের পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হন এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেনও।’ এর পরের অংশ এখানে উল্লেখযোগ্য। ‘বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দর্শনার্থীর অধৈর্য ভিড়। সকাল ১০টায় আহূত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগদানের তাড়া। ফলে দুজনের আলোচনা আর এগোতে পারেনি। তাজউদ্দীন জানান, তার আরও কিছু জরুরি কথা ছিল—মুক্তিযুদ্ধের এই ন’মাসে কোথায় কী ঘটেছে, কোন নীতি ও কৌশলের অবলম্বনে, কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কী পরিবর্তন ঘটেছে দেশবাসীর মনোজগতে, তরুণদের প্রত্যাশা ও মূল্যবোধে। কেননা, এসব কিছুর মাঝেই নিহিত ছিল দেশের পরবর্তী সংগ্রামের, তথা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সংহত ও স্থিতিশীল করার এবং সাধারণ দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইকে সাফল্যমণ্ডিত করার মূল সূত্র; কিন্তু তখন এসব কিছু আলোচনার সময় ছিল না। পরেও কখনো সে সুযোগ তাজউদ্দীনের ঘটে ওঠেনি।’ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা ফুটিয়ে তোলার জন্য এই বক্তব্য যথেষ্ট। এখান থেকে বোঝা যায় কী কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জনগণের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষার বিকাশ ঘটেনি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্ব, শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকার পরও যিনি স্বাধীনতার প্রতীক ও পরবর্তী সময় ক্ষমতা নেয়, তাকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলতে পারেনি। উপরন্তু, ১৯৭৪ সালে তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে বহিষ্কৃত হন। তাজউদ্দীন আহমদ বিদেশি সাহায্য, উন্নয়ন, পরিকল্পনা যেভাবে গ্রহণ করছিলেন, তার থেকে সরকারেরও বিচ্যুতি ঘটতে থাকে। রাষ্ট্র সেই পাকিস্তানের উন্নয়ন ধারা অনুযায়ীই অগ্রসর হতে থাকে। তাই ৫৩ বছর পরও এত নামকরণ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অবদানের ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিটির এই পরিণতি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় প্রতিফলিত হয়।
লেখক: অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিন্ট/ডাউনলোডঃ ১২ই আগস্ট, ২০২৫, দুপুর ১২:৩৭
© স্বত্ব দৈনিক সমধারা ২০২৫
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি