জুলাইসনদ
“Hegel remarks somewhere that all facts and personages of great importance in world history occur, as it were, twice. He forgot to add: the first time as tragedy, the second as farce.” —Karl Marx
এই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায়, যখন আমরা দেখি—বাংলাদেশে ইতিহাস শুধু ফিরে আসে না, মাঝে মাঝে উপহাস হয়ে ফিরে আসে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ: গৌরব থেকে গণদুর্ভোগ
একটা সময় ছিল, যখন গ্রামগঞ্জে কেউ ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী’ পরিচয়ে দাদাগিরি করতো, বীরত্ব নয়, জুলুম নিয়ে। এদের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন, তবে সবাই ছিলেন না। অনেকেই রাজনৈতিক বলয়ের সুযোগ নিয়ে সনদ পেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ ছিল না—এই সনদ কারা, কীভাবে, কোন মানদণ্ডে পেয়েছে।
তারপর শুরু হয় কোটা প্রথার সুবিধা বণ্টন। সেই সনদের সূত্র ধরে ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনিরাও চাকরি ও সুযোগ দখলে নেন। ফলাফল? বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ, দমে যায় প্রতিভা, ধ্বংস হয় ন্যায্যতার ভিত্তি।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল এই জুলুমের সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু প্রশ্ন জাগছে—আজকের ‘জুলাইসনদ’ কি সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে?
জুলাইসনদ: বিপ্লবের স্মারক না কি নতুন ‘সুবিধাবাজির লাইসেন্স’?
সম্প্রতি বিতরণ শুরু হয়েছে তথাকথিত ‘জুলাইযোদ্ধা সনদ’। প্রশ্ন একটাই—এই সনদ কারা পাচ্ছে? কোন মানদণ্ডে? জনগণের জানার অধিকার কোথায়?
জুলাইয়ে আমরা দেখেছি—বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই (সরকারি দল ব্যতীত) রাজপথে নেমেছিল। কর্মচারী, ছাত্র, গার্মেন্ট শ্রমিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বৃদ্ধা মা, তরুণ কিশোর—সবাই ছিল এই অভ্যুত্থানের অংশীদার। তাহলে কেন এই সনদ আজ কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত? কেন তা হয়ে উঠছে ‘নতুন দাদাদের’ লাইসেন্স?
স্থানীয়ভাবে শোনা যাচ্ছে, কিছু আমলা ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীর যোগসাজশে এই সনদ বিতরণ চলছে। কারা “জুলাইযোদ্ধা”, সেই সংজ্ঞা যখনই অস্বচ্ছ হয়, তখনই বিপ্লব দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যায়।
আমরা কী চাই?
সকল শহিদ পরিবার ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিতে রাষ্ট্র দায়িত্ববান হোক।
‘সনদ’ হোক শুধু একটি স্মারক, কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় বা চাকরির সুযোগের ভিত্তি নয়।
জুলাই আন্দোলনের প্রকৃত অংশগ্রহণকারীদের সম্মান নিশ্চিত হোক, দলীয় নয়—জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।
সনদ বিতরণ হোক স্বচ্ছ মানদণ্ডে, জনসমক্ষে উন্মুক্ত তথ্য-প্রক্রিয়ায়।
ইতিহাস যেন আবার প্রহসন না হয়
আমরা ‘মুক্তিযোদ্ধা নামধারী সুবিধাবাজদের’ রূপ দেখেছি—তাদের আবার সমাজে হাজির হোক, তা কেউই চায় না। জুলাই আন্দোলনের চেতনা কোনো দলীয় সম্পত্তি নয়—এটা জনগণের। সেই জনগণের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে অর্জিত চেতনা যেন আবার দুর্নীতির লাইসেন্সে পরিণত না হয়।
জুলাই আমাদের শেখায়—রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়, মানুষ তখন নিজেই ইতিহাস লেখে। কিন্তু সেই ইতিহাস যদি আবার সনদে বন্দি হয়ে কিছু ‘নতুন দাদা’-র কাছে চলে যায়, তাহলে বিপ্লব থেকে আর একটি প্রহসন তৈরিই শুধু সময়ের ব্যাপার।
শেষ কথা: জুলাই আন্দোলন ছিল বিভাজনের বিরুদ্ধে—তাকে আবার নতুন বিভাজনের হাতিয়ার বানানো হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। তাই এখনই দরকার, সত্যিকারের অংশীদারিত্ব ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমরা কেউই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা জুলাইয়ের শহিদদের অসম্মান করতে চাই না—আমরা শুধু চাই, সুবিধাবাজের শেকড় আর না গজাক।
প্রিন্ট/ডাউনলোডঃ ১২ই আগস্ট, ২০২৫, সকাল ১১:৫৮
© স্বত্ব দৈনিক সমধারা ২০২৫
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি