সমধারা

আগস্ট ২, ২০২৫ , ১১:৪৩ অপরাহ্ণ

ইতিহাস,সংস্কার ও নির্বাচন

রবি রায়হান

কবি ও কলাম লেখক

পৃথিবী সৃষ্টির লগ্ন থেকেই যুগে যুগে ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়েই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। নব নব সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে। ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে পূর্বের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কুসংস্কার, অনিয়ম দুর্নীতি, অনৈতিকতা, সামাজিক ব্যাধি ও ব্যভিচার দূর করে মানুষের খর্বিত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে । মানব সভ্যতা ভাংগা-গড়া ও বিবর্তনের মাধ্যমে যুগে যুগে মানব জাতি সমৃদ্ধি লাভ করেছে এবং মানব সভ্যতার ইতিহাস ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার রচিত হয়েছে।
যেমন ইতিহাস সাক্ষী আন্দোলন ও বিপ্লবের মাধ্যমে মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুদের নিষ্পেষনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল মধ্য ইউরোপের ভূমিদাস কৃষককুল। ইতিহাস সর্বদা নির্মম সত্য বুকে ধারণ করে চলে যুগের পর যুগ । ইতিহাস পাল্টে ফেলা যায় না , ভাঙাগড়ার খেলা শেষ হলে স্বমহিমায় সত্য বুকে ধারণ করে ফিরে আসে বার বার । ইতিহাস বিকৃত করে মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করা যায়না হয়ত কিছু সময় মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো যায়। বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব মনসুর উল-মুলক সিরাজ উদ্দৌলা শাহ কুলি খান মির্জা মুহম্মদ হয়বৎ জঙ্গ বাহাদুর এর নিজের একান্ত কিছু মানুষের বেইমানীতে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে নেয় । তারপর ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকগণ নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জমিদারি প্রথা চালু করে। তাদের অনুগত লোক দিয়ে দেশের বেশির ভাগ ভূমির মালিকানা তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ প্রজাদেরকে রায়তি বানিয়ে দেয় ।সে কারণে অখন্ডিত ভারতবর্ষে জমিদারি ব্যবস্থার প্রচলন বিস্তার লাভ করতে থাকে । যুগে যুগে অত্যাচারিত হয়ে ভূমিহীন প্রজাসাধারন জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠে।দুইশত বছর ইংরেজ শাসনকালের শেষ ভাগে এসে তৎকালীন অখন্ডিত ভারতবর্ষের মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নেতৃত্বে বাংলার সাধারণ জনগণকে এ মর্মে বুঝাতে সক্ষম হন যে, ব্রিটিশ বেনিয়াদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিতাড়িত করতে পারলে এবং এদেশের জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেই সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করে সকল জমির রায়তদের যার যার দখলীয় ভূমির মালিকানা তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, সে ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভারত বর্ষে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দুটি রাষ্ট্র হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান গঠিত হয়।পাকিস্তান দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত হয়।পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। উপরের ইতিহাস সকলেরই জানা তবুও আজকের আলোচনার স্বার্থে পাঠকগণকে পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা হলো।অধিকার আদায়ে বাংলার জনগণ কোনদিনই পিছপা হয়নি। ১৯৫২ সালে রফিক শফিক ও বরকত বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। একই দেশের নাগরিক হয়েও বাঙালী জাতি বৈষম্যের শিকার হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশটাকে স্বাধীন করেছে বীর বাঙালী। এই জাতিকে লাল সবুজের পতাকা এনে দিয়েছে, আরও দিয়েছে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত জাতীয় সঙ্গীত। সেই বীর জাতিকে শাসকগোষ্ঠির অধিকার বঞ্চিত করে রাখা সহজ সাধ্য কাজ হবে না এটায় স্বাভাবিক। বাঙালী জাতি অধিকার আদায়ে সর্বদা অগ্রগামী। প্রথমে শাসক কুল জনগণের সেবক হওয়ার ওয়াদা করে ক্ষমতার মসনদে বসে, সেবক যখন দিনে দিনে একনায়ক শাসকে পরিণত হয় তখন জনগণের সমস্ত অধিকার ভুলুণ্ঠিত হয়। রাজা প্রজার সম্পর্ক তৈরী করে।প্রজাগণের সুখশান্তি রাজার নিকট গৌণ হয়ে উঠে। একনায়ক শাসক ক্ষমতার দম্ভে চাটুকারদের নিয়ে ভোগবিলাসে মত্ব হয়ে পড়ে। রাজ্যের প্রজাগণের খোঁজ খবর রাখেনা।প্রজাগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে ।চাটুকারদের তোশামদীর বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে একনায়ক শাসক দিনে দিনে প্রজা সাধারণের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। চাটুকারদের দুর্বিসহ অত্যাচারে জর্জরিত প্রজাগণ রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। ক্রোধান্বিত প্রজাগণ মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ বুঝে রাজার বিরুদ্ধে, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। রাজাকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতার মসনদ থেকে নামিয়ে দেয়। কোনো সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারী আচরণ করতে শুরু করে । আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের সাথে ঠিক রাজা ও প্রজার শাসন কায়েম না করলেও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে একনায়কের চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে শাসক কুলের মনে অহমিকার জন্ম নিয়ে ছিলো । তাঁরা ভাবতে শুরু করেছিল তাঁদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী । তারা ভুলতে বসেছিল এই দুনিয়ায় ক্ষমতা ও অর্থ কারো চিরদিন থাকে না। হাত বদল হতেই থাকে এবং এটাই ধ্রবসত্য। আওয়ামীলীগের মতো একটা বিশাল জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলের সরকার সামান্য আন্দোলনে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে ।ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতার মসনদে বসুক না কেন। আওয়ামীলীগের করুণ পরিণতির ইতিহাস তাদের স্মরণ থাকলে তাদের এবং জনগণের উভয়ের জন্যই মঙ্গল হবে।

রবি রায়হান, কবি ও কলাম লেখক

বর্তমান অনভিজ্ঞ ইন্টেরিম গভর্মেন্ট বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে । আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, দেশে মব জাষ্টিস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সহ সমস্ত বিষয় জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছে । ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, গার্মেন্টস সেক্টরে অশণি সংকেত দেখা দিয়েছে। এ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার পারদ প্রথম দিকে আকাশচুম্বি ছিলো। সময় যত গড়াচ্ছে জনগণের আশার বেলুন চুপসে যাচ্ছে ।
চাইলেও এই সরকারের দ্বারা কোন কিছুই করা সম্ভব হবে না কারণ এই সরকারের জনভিত্তি বা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ক্ষমতা নাই ।
রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার ক্ষত পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের উপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস দিনে দিনে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জনগণের আস্থা,যা,তাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রাজনৈতিক সরকারের ন্যায় প্রতিহিংসার রাজনীতির পথ তারা অনুসরণ করছে যা জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। পরিবর্তন যদি মঙ্গল বয়ে না আনে তা জনগণ গ্রহণ করে না । পরিবর্তন হতে হবে, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য। তবেই সেই পরিবর্তন জনগণ নিকট গ্রহণ যোগ্য হবে।
এই সরকারের ক্ষমতায় বিচরণের সাংবিধানিক ভাবে কোন সময় সীমা বা ক্ষমতার আওতা কতখানি তার বাধ্যবাধকতার সীমা সংবিধানে নিদ্রিষ্ট করা নেই। সংবিধানের আলোকে এই সরকার বৈধ নয় । সুতরাং তাদের কোনো ধরনের সংস্কারও বৈধ নয় বলে বিবেচিত হবে । যদি পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার তাদের সংসদে এই সরকারের ও তাদের সংস্কারের বৈধতা না দেয় তবে এ সরকার ও সরকারের কর্ম অবৈধ বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। এই সরকারের উচিৎ হবে যত দ্রুত সম্ভব একটি নিরেপক্ষ নির্বাচন দিয়ে সেফ এক্সিট নেওয়া। শুভস্য শীঘ্রম। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র সংস্কারের নামে রাষ্ট্রকে নিয়ে ছেলে খেলা করা সমীচিন হবেনা। বর্তমান সমন্বয়করা দেশটা কে নিয়ে ছেলে খেলা শুরু করেছে । বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে সব কিছুই তো খারাপ হতে পারেনা। একাত্তর সালে মীমাংসিত বিষয় গুলো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করার কোন অবকাশ নেই। সার্বভৌমত্ব ,জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, মানচিত্র এইগুলো মীমাংসিত বিষয়। এ সমস্ত মীমাংসিত বিষয়ে স্বাধীনতার বায়ান্ন – তেপান্ন বছর পরে এসে আঘাত করা মানে স্বাধীনতা অস্বীকার করা এবং বাংলাদেশটাকে অস্বীকার করা। এগুলো ছাড়াও অনেক অনেক বিষয় আছে, যেগুলো সংস্কার করলে জনগণের উপকারে আসবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সে সমস্ত বিষয় গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে সংস্কার করতে হবে। তবে সংস্কার করলেই যে তা টিকে থাকবে তার কোন গ্যারান্টি নাই, কারণ সমস্ত সংস্কার সংসদে পাস হতে হবে। যা নির্বাচিত সরকারের এখতিয়ার। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, অনৈতিকতা মানুষের অন্তরে বিষবাষ্পের ন্যায় সর্বদা ধূমায়িত হয়। যার অর্থ সম্পদ আছে সে অন্যায় করলেও সমাজের বেশিরভাগ মানুষ অন্যায়কারীর পক্ষ নেয়, পক্ষান্তরে দুর্নীতির পক্ষ অবলম্বন করে।
সামান্য কথা কাটাকাটির বিষয় কে কেন্দ্র করে মানুষকে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছে। বর্তমানে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিস্ক্রিয়তার কারণে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে । মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করছে।
দেশের মানুষ যে আশা নিয়ে পরিবর্তন চেয়ে ছিলো তা অর্জিত হয়নি বরং মানুষ এখন দুই সরকারের তুলনা করে আগের সরকার ভালো ছিলো বলতে শুরু করেছে ।
তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এটুকুই বলতে হয় যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে সন্মান জানানোই হবে একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ ।

প্রিন্ট/ডাউনলোডঃ ১২ই আগস্ট, ২০২৫, সকাল ১১:৩১

© স্বত্ব দৈনিক সমধারা ২০২৫

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

প্রিন্ট করুন

সেভ করুন