সকল মেনু

সুফি সাধক : শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)

বালাকোট যুদ্ধের গাজী হজরত শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ: একজন নন্দিত সাধক পুরুষ। সমসাময়িক সমাজব্যবস্থায় রেসালাতে মোহাম্মদ সা:-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের তিনি বালাকোটের প্রান্তরে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে গাজী উপাধিতে ভূষিত হন এবং মুসলিম পুনর্জাগরণ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে গেছেন।
আনওয়ারুন নাইয়্যেরাইন গ্রন্থে খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর পূর্বপুরুষ গজনির অধিবাসী ছিলেন। তারা গজনি থেকে নোয়াখালী হিজরত করেন। সুফি নূর মোহাম্মদের পিতা মোহাম্মদ ফানাহ নোয়াখালীর নিবাসী ছিলেন এবং নোয়াখালীতে নূর মোহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন।
শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ: জন্ম আনুমানিক ১৭৯০ সালে। বাবার কাছে সুফি সাহেবের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর নোয়াখালীর বাহমনী এলাকার শেখ জাহেদ-এর তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করেন। অল্প বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষার অনুরাগ প্রবিষ্ট হয়েছিল। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষার্থে মাতৃভূমি ত্যাগ করে কলকাতা মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। মাদরাসা আলিয়ায় শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন। প্রখ্যাত লিখক আল্লামা নূর মোহাম্মদ আজমী রহ: তাঁর গ্রন্থে শাহ্ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:কে চট্টগ্রামের মোহাদ্দেসিনে কেরামদের তালিকাভুক্ত করেন। তিনি কলকাতায় সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ:-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন।
শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ: ছিলেন আপসহীন মুজাহিদ। বালাকোট যুদ্ধের সময় তিনি দিনে নিজের তাজা খুন দিয়ে জিহাদের ময়দান রঞ্জিত করতে চেষ্টা করতেন, রাতে তাহাজ্জুদের মসল্লাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমের অশ্রু দিয়ে সিক্ত করতেন। বালাকোট যুদ্ধের পর তিনি কিছু দিন কলকাতায় অবস্থান করেন। তার নামে নানা অলৌকিক বর্ণনা বা গল্পও প্রচলিত আছে।
শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর অসিয়ত অনুযায়ী তার ব্যবহৃত শেরওয়ানি খানা উপজেলার মোবারকঘোনা এলাকার হজরত মাওলানা শাহ্ সূফী আকরাম আলী রহ:কে প্রদান করা হয়। তাঁর ইন্তেকালের পর অদ্যাবধি তাঁর বংশধরদের কাছে ওই তাবাররোকাত সযতেœ সংরক্ষিত আছে। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে জামাটির রঙ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাই ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে জামাটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর নামে সুফিয়া নূরিয়া ফাজিল মাদরাসা, শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ: মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদরাসা রয়েছে।
বিভিন্ন লেখকের মূল্যায়ন : ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ তার ‘বাংলাদেশে খ্যাতনামা আরবিবিদ’ নামক গ্রন্থে ২৩ জন আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন। সেখানে শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রখ্যাত লেখক আল্লামা নূর মোহাম্মদ আজমি রহ: তাঁর মেশকাত শরিফের (প্রথম খণ্ডে) তাকে মোহাদ্দেসিন কেরামদের তালিকাভুক্ত করেছেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার ‘কুরআনে স্বাধীনতার বাণী’ গ্রন্থে শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:কে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গোলাম রসুল মেহের তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ‘শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ বাঙালি’ শিরোনামে একটি মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামি বিশ্বকোষ-এর ১৪ খণ্ডে উল্লেখ আছে তিনি ছিলেন উঁচুমাপের আলেম ও মুহাদ্দিস। সমকালের শ্রেষ্ঠ কামিল বুজুর্গ। শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর জীবনী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো গ্রন্থ নেই। তবে ড. মতিউর রহমান রচিত আইনায়ে ওয়াইসি, খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ রচিত আহাদিসুল খাওয়ানিন, চল্লিশ আওলিয়ার কাহিনী ইত্যাদি গ্রন্থে সুফি সাহেবের জীবনের কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়। এ ছাড়া ১৯৬৩ সালে মাওলানা রিজওয়ানুল হক ইসলামাবাদী, ১৯৮৯ সালে এ বি এম আবদুল মান্নান চৌধুরী, ১৯৮৮ সাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ২০০২ সালে মোহাম্মদ সাইফুল হক সিরাজী শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ:-এর জীবনী নিয়ে গ্রন্থ লেখেন।
ওফাতের তারিখ ও সন
হজরত শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রহ: ১২৭৫ হিজরির ২৪ রবিউল আউয়াল, ১৮৫৮ ইংরেজির পয়লা নভেম্বর, ১২৬৬ বাংলার ১৩ কার্তিক ওফাত পান। তিনি অছিয়ত করে যান মৃত্যুর পর যেন কবরের ওপর ঘর বা গম্বুজ না করে। কবর নিয়ে যেন অযথা ব্যয় না করে এবং কবরকে ঘিরে শরিয়তবিরোধী যেন কোনো কাজ না করা হয়। তার মৃত্যুর পর অদ্যাবধি তার অছিয়ত বাস্তবায়ন রয়েছে। কবরের চার পাশে দেয়াল দেয়া হলেও ছাদ কিংবা গম্বুজ দেয়া হয়নি। প্রত্যেক বছর বাংলা বর্ষের ১৩ কার্তিক ইছালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে মাহফিল করলেও শরিয়তবিরোধী কোনো কাজ করা হয় না।
আলহাজ হাফেজ সৈয়দ আবুল বাশার মোহাম্মদ বশির উদ্দিন সাহেব রহ:-এর একান্ত প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৫ সালের ১৩ কার্তিক ইসালে সওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়মিত এবং ১৯৭৬ সাল থেকে মাহফিলটি ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৮০ সাল থেকে বৃহদাকারে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে বার্ষিক ইসালে সওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
গাজীয়ে বালাকোট শাহ্ সুফি নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রা:-এর কবর চট্টগ্রামের নিজামপুর পরগনার মিরসরাই উপজেলার মিঠানালা ইউনিয়নের মলিয়াইশ গ্রামে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ মাইল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গুলিস্তান ফিলিং স্টেশন থেকে তিন মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে প্রতি বছর ইসালে ছাওয়াবের মাহফিল ছাড়াও শুক্রবার ও সপ্তাহের অন্যান্য দিন জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আসেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

TOP