এখন জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসঘটিত নানা রোগ। টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু কিংবা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ এলেও উপসর্গ থেকেই যাচ্ছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, রোগীদের অর্ধেকই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত।
চলতি বছরের জুলাই মাসে ১৯টি হাসপাতালে তীব্র জ্বর, কাশি এবং শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে আসা ১ হাজার ৮৪৭ জন রোগীর ওপর আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বি ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স পরিচালনা করেছে। তাতে দেখা গেছে, আক্রান্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে প্রায় ৬ জন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। আইইডিসিআর জানায়, ২০২৩ সালে এই হার ছিল অনেক কম, ২৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল জুন মাসে, ৩৭ শতাংশ। ২০০৭ সালের পর থেকে এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শ্বাসযন্ত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মৌসুমি ফ্লু হয়, যা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণরা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হতে পারেন।
চিকিৎসকদের মতে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম। সে জন্য এই মৌসুমে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, যেমন- মাস্ক পরা, মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া, হাত ধোয়া ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। প্রতিবছর ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের (৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যারা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, গর্ভবতী নারী, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু) জন্য ফ্লু টিকা নেওয়া জরুরি। কোনও কারণে ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে টিকা নিতে না পারলে মৌসুম শুরু হওয়ার পরেও টিকা নেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে সর্দি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল ৪ হাজার ২৪ জন শিশু। জুলাই মাসে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ২৫৫ জন। ওই মাসে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৯ হাজার ৩৬৭ জন শিশু চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ২৫৫ জন, অর্থাৎ ৬৬.৬৭ শতাংশই সর্দি-জ্বরে ভুগেছে। আগস্ট মাসের প্রথম ২০ দিনে এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২ হাজার ২২৯ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৯২১ জন, অর্থাৎ ৮৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এসেছে সর্দি-জ্বর নিয়ে।
আইইডিসিআর পরামর্শ দিয়েছে—ফ্লু’র মৌসুমে সাবান পানি অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করুন। কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু দিয়ে বা বাহুর ভাঁজে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন, ব্যবহৃত টিস্যু সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ফেলে দিন এবং সাবান পানি, অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলুন। আপনার যদি জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকে— তবে সুস্থদের থেকে দূরে থাকুন। যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করুন। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যারা দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে ভুগছেন এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী—এদের জন্য প্রতি বছর ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জার (ফ্লু) ভাইরাসের টিকা নেওয়া দরকার।
জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাসজনিত জ্বর মৌসুমি জ্বরের মতো। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে জ্বর অনেক বেশি বা কম হতে পারে। শরীরে ব্যথা থাকে। তীব্র মাথা ব্যথা থাকে, কাশি থাকতে পারে। এছাড়া খুব দুর্বল লাগতে পারে। সর্দি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। এই জ্বর অনেকটা করোনা বা ডেঙ্গুর লক্ষণের মতো। কখনও কখনও শরীরে র্যাশও হয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্বাভাস-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে টানা বৃষ্টি হওয়ায় ও বিগত বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে হাসপাতালগুলোতে ভর্তির চাপও বাড়তে পারে। তবে অক্টোবরে বর্ষা শেষে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দ্বিতীয় দফায় প্রাদুর্ভাব চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এ সময়ও লার্ভিসাইডিং ও স্যানিটেশন কার্যক্রম জোরদার রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ম্যালেরিয়ার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে সব সংস্থাকে একটি ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘কোনও একটা সংস্থা বা হাসপাতালের পক্ষে একা রোগী নিয়ন্ত্রণ বা মশা নিধন করা সম্ভব নয়। প্রতি বছরই তো একইভাবে চলছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করা উচিত আইডিসিআরের মতো, যারা সমন্বয় করে কাজ করবে।’
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাসার বলেন, ‘কয়েকদিন পরে যখন বৃষ্টিপাত কমে যাবে, তখন ডেঙ্গু রোগী ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করবে। কারণ, তখন এডিস মশার ঘনত্বটা বাড়তে শুরু করবে। ডেঙ্গুর পিক মৌসুম এখনও আসেনি। সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে না পারলে আগামী দুই মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।