পুরো বিশ্বকে এমন এক চরম অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে, এই বর্বরতা আর সহ্য করা সম্ভব নয়। প্রতিটি দেশের সরকার, জাতিসংঘ, সব আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর এখন দৃঢ় অবস্থান নেওয়া আবশ্যিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক, চিন্তক, কবি, শিল্পী, সম্পাদক, সাংবাদিকসহ প্রত্যেক বিবেকবান মানুষকে একত্রিত হয়ে অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধের জন্য কাজ করতে হবে। মানবতার নৈতিক কর্তব্য হলো, এখনই উঠে দাঁড়ানো ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
নেতানিয়াহুর অনুসারীরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয় এবং ইচ্ছেমতো তাদের হত্যা করা যায়। তবে গত দুই বছর ধরে গাজায় অব্যাহত বোমাবর্ষণ, খাদ্য, ওষুধ ও পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে বিশ্বকে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, আসলে এই হত্যাকারী ও তাদের অনুসারীরাই মানুষ নয়। ইসরায়েলি নেতৃত্ব নিজেদের মানবজাতির সবচেয়ে নৃশংস প্রজাতিতে নামিয়ে এনেছে।
ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণকে এই গণহত্যার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা একটি প্রতারণা। আর তা আজ পুরো বিশ্বের কাছে স্পষ্ট এবং এই অজুহাত বিশ্ব প্রত্যাখ্যান করছে। সেই হামলার ঘটনার দুই বছর পরও এভাবে নৃশংসতা চালিয়ে যাওয়া স্পষ্টতই প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলের উদ্দেশ্য আত্মরক্ষা নয়, বরং প্রতিটি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা এবং তাদের সম্পূর্ণ ভূমি দখল করা।
ফিলিস্তিনে প্রতিদিন মানুষ হত্যা করা হচ্ছে এবং সেই সংখ্যা হতবাক করে দেওয়ার মতো। শিশুরা পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। অথচ কোনোভাবেই এই সহিংসতা তারা উসকে দেয়নি এবং এর সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
গাজায় অবিরাম হামলা চালানো হচ্ছে। ড্রোন, বোমা, রিমোট-নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র নির্বিচারে সেখানকার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটে আঘাত করছে। রোবট বুলডোজার প্রতিদিন প্রায় ৩০০ বাড়ি ধ্বংস করছে, কোনো কাঠামো অক্ষত থাকছে না এবং পুরো মহল্লার নিশানা মুছে ফেলা হচ্ছে।
ইসরায়েল পশ্চিম তীরেও হত্যাযজ্ঞ বাড়িয়েছে। সেখানেও ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে এবং মানুষ হত্যা করছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, কিছু ইসরায়েলি নাগরিক অনলাইনে প্রকাশ্যে ডাক দিচ্ছে ‘তাদের (ফিলিস্তিনিদের) শিশুদের হত্যা করো’ এবং এর পেছনে যুক্তি দিচ্ছে, তারা ‘বড় হয়ে সন্ত্রাসী হবে’।
গাজার হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়েছে, স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, লাখো শিশু ক্ষুধা, রোগ ও মানসিক আঘাতে ভুগছে। ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা ও বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করায় এটা স্পষ্ট যে, কেবল মানুষের জীবন নয়, বরং ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। বিশ্ব এক অকল্পনীয় মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছে, তারপরও হামলা অব্যাহত রয়েছে।
তারা কাতারে বোমা হামলা চালিয়েছে, পরে ইয়েমেনেও। এর আগে তারা লেবানন, ইরান ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছিল।
ইসরায়েল আজ শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং সব প্রতিবেশী দেশের জন্য হুমকি, সভ্য বিশ্বের জন্য হুমকি। কারণ তারা ভেঙে দিচ্ছে প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিটি মানবিক মূল্যবোধ, সভ্যতার সব অর্জন, সৌজন্যের প্রতিটি ধারণা, সহনশীলতার প্রতিটি নীতি এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ—যা আমাদের সভ্যতার শিকড়ে মিশে আছে।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সেটাই করছে, যা নাৎসিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের সঙ্গে করেছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফিলিস্তিনিদের ওপর ‘হলোকাস্টে’র পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, যেখানে বর্তমান হত্যাকারীরাই একসময় ছিল ভুক্তভোগী। একসময় পুরো বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেভাবে নাৎসিদের ধ্বংস করেছিল, আজও একইভাবে এই গণহত্যা থামাতে হবে এবং যে সরকার এটা করছে, তাদের ধ্বংস করতে হবে।
শিল্পোত্তর যুগে পশ্চিমারা দাবি করেছিল, তারা মানবতার সর্বোচ্চ মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ আজ তাদেরই একটি অংশ আমাদের সব পবিত্র মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। যদি পশ্চিমা বিশ্বের বাকি অংশ অবিলম্বে এই গণহত্যা থামাতে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তারা বিশ্বের বাকি অংশে নিজেদের মর্যাদা হারাবে।
সেখানে যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তা বিশ্বের প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে স্পষ্ট করা যাবে, প্রশ্নটি হলো, আপনার সন্তানকে নিজের কোলে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখলে কেমন লাগবে? যখন সন্তান ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য এক টুকরো খাবার, এক টুকরো রুটি, এক চুমুক পানি চাইছে, আর আপনি দিতে পারছেন না। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন অসহায়ভাবে, অনুতাপ ও অপরাধ বোধ নিয়ে, ক্রোধ নিয়ে, আপনি পূরণ করতে পারছেন না সন্তানের সবচেয়ে মৌলিক এই চাওয়া, কিংবা তাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা।
এই যন্ত্রণা একদিনে শেষ হয় না, এক সপ্তাহেও না, এমনকি কয়েক মাসেও না। আপনার চোখের সামনে প্রিয় সন্তান ক্রমে ওজন হারাচ্ছে, ইন্দ্রিয়শক্তি হারাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, পাঁজরের হাড় বেরিয়ে আসছে, চোখ বসে যাচ্ছে, সন্তান হাসছে না, কথা বলছে না, হাত-পা নাড়াচ্ছে না, কান্নার শক্তিটুকু নেই, এমনকি শ্বাসও নেওয়ার শক্তি হারাচ্ছে—কেমন অনুভূতি হবে আপনার?
আর সবচেয়ে কঠিন বিষয় তো তখন হয়, যখন এসব আপনার চোখের সামনে ঘটছে, তাও আবার একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থল আপনারই বুকে!
হে বিশ্বের বাবা-মায়েরা, আর কতদিন আমরা চোখ ফিরিয়ে থাকব? আর কতদিন এভাবে কারো সন্তানকে হত্যা করতে দেব? প্রতিদিন ইসরায়েল আরও বেশি ফিলিস্তিনি হত্যার নতুন করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাই জেগে উঠুন। আমরা এ পৃথিবীর প্রত্যেক বাবা-মাকে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই।
সমগ্র বিশ্বের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান, আর চুপ করে থাকবেন না, এখনই ব্যবস্থা নিন।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।