সওগাত পত্রিকা অফিসে নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত, যেখানে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইবরাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান।
বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই, যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণিতে পড়তেন। তার বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নূরজাহান বেগমের মতো যারা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়তেন, তারা সবাই মিলে বেগম-এর জন্য কাজ করতেন। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খানকে (দাদাভাই)। ১৯৫০ সালে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন।
ঢাকায় এসে নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন নূরজাহান বেগম, যাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। যারা লেখা পাঠাত, তাদের ছবিও ছাপাতেন বেগম পত্রিকা। প্রথমদিকে পুরুষরাও এতে লিখতেন। তবে এখন এতে শুধু নারীরাই লিখে থাকেন। ১৯৫৪ সালে মার্কিন মহিলা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মিসেস আইদা আলসেথ ঢাকায় বেগম পত্রিকা অফিস পরিদর্শন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা।
নূরজাহান বেগম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকার শরৎ গুপ্ত স্ট্রিটের ৩৮ নম্বর বাড়িতে প্রায় ৬৪ বছর ধরে বসবাস করেছেন। নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বেগম-এর প্রথমদিকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা লেখা ও ছবি সংগ্রহ করতেন।
নূরজাহান বেগম বলেন, মেয়েরা এখন হরহামেশা বাইরে পড়তে যাচ্ছে। উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরছে। তারপরও আমার মনে হয়, নারীকে আরো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। তাহলে সামাজিক উন্নয়ন দ্রুত ঘটবে। যোগ্যতার সুবিচার করতে হবে তাঁদের।
পত্রিকার বাইরে তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ, মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে সমাজসেবা করেছেন।
১৯৯৬ সালে নূরজাহান বেগম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট, ২০০২ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যাশিশু দিবস উদ্যাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন।
এ ছাড়া তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিস ক্লাব, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে। ২০১০ সালে পত্রিকাশিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।
৫ মে ২০১৬ তারিখে অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৬ সালের ২৩ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।