জুলাই গণহত্যা
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও গণহত্যা একটি জাতির বিবেকের ওপর রক্তাক্ত দাগ হয়ে চিরকাল লেগে থাকবে। নেত্র নিউজ পরিচালিত এক গবেষণায় ৭৫০ জন শহীদের মৃত্যু নিয়ে বিশদভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গবেষণা কেবল সংখ্যালঘু কিছু মানুষের নয়, বরং পুরো একটি প্রজন্মের বিনাশ এবং রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার নগ্ন চিত্র প্রকাশ করেছে।
একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রজন্ম
গবেষণায় দেখা গেছে, শহীদদের ৬১.৩১ শতাংশের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। অর্থাৎ নিহতদের বড় একটি অংশই কিশোর-তরুণ, যারা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিও পেরোয়নি। তারা ছিল বাংলাদেশে জেনারেশন Z— যারা তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা ও মানবিক চেতনায় একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন একে একে গুলির আওয়াজে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।
নিরাপত্তা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নগ্নতা
প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ৯৭.১৬ শতাংশ শহীদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কারফিউ চলাকালীন (২০-২২ জুলাই) সময়ে নিহত সবাই গুলিবিদ্ধ হন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—এটি একটি সুনির্দিষ্ট, পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। এটি ছিল কোনো সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা নয়, বরং জনতাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োগ।
ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাস ও প্রশাসনের সহযোগিতা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুলির উৎস ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কিন্তু কিছু ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। কোথাও ছুরিকাঘাতে, কোথাও পিটিয়ে, আবার কোথাও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িচাপায় মানুষ নিহত হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে যে প্রশাসন ও দলীয় সন্ত্রাস একত্রে কাজ করেছে—a collusion of violence.
ঢাকা গণহত্যার কেন্দ্রবিন্দু
রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে। মোট শহীদের ৬৪ শতাংশ, অর্থাৎ ৪৭৯ জন নিহত হয়েছেন শুধুমাত্র ঢাকায়।বিশেষ করে ওয়ারী, উত্তরা, মিরপুর ও গুলশান এলাকায় প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্যামেরা, সবচেয়ে বেশি সংবাদমাধ্যম, সেখানেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু—এটাই বলে দেয়, এই গণহত্যা ছিল জনসম্মুখে ভয় দেখানোর একটি রাষ্ট্রীয় প্রচারণা।
দলীয় পরিচয় নয়, লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ১২.২২% নিহত বিএনপির এবং ২.১৩% জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বাকি ৮৫% এর বেশিমানুষ ছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। কেউ পথে ছিল, কেউ ছাদে, কেউ খাবার কিনতে বের হয়েছিল, কেউ পরিবারের পাশে ছিল। এখানে প্রশ্ন জাগে—এই মানুষগুলো কেন নিহত হলো? এদের অপরাধ কী ছিল? উত্তর একটাই: তারা রাষ্ট্রীয় দমননীতির শিকার।
শিশুও রক্ষা পায়নি
প্রতিবেদনে সর্বকনিষ্ঠ শহীদের বয়স মাত্র চার বছর। একজন চার বছরের শিশুর গায়ে গুলি লাগবে—এ কথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সরাসরি war crime বা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে।
এখানে রাষ্ট্রের অস্ত্র চলে গেছে তার নাগরিকের কণ্ঠস্বর, চোখ ও ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে।
ভয় দেখানোর কৌশল
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে—বাড়িতে অবস্থানরত দর্শকদের ওপর গুলি চালানো ছিল একটি পরিকল্পিত কৌশল, যার উদ্দেশ্য ছিল—
“মানুষকে ভয় দেখানো, মুখ বন্ধ রাখা এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা।”
এটি শুধুমাত্র দমন নয়, বরং মানুষের চেতনা, সাহস ও ঐক্যের ওপর এক নিষ্ঠুর আঘাত।
রাষ্ট্র ও জাতির জন্য প্রশ্ন:
এই ৭৫০ জন শহীদের রক্ত কি কারো জন্য কিছুই নয়? তারা কি শুধুই পরিসংখ্যান? নাকি তারা একটি অন্যায়ের প্রতীক, একটি প্রতিবাদের সুর, একটি নিষ্ঠুর সময়ের সাক্ষ্য? এদের বিচার কি হবে? আন্তর্জাতিক তদন্ত কি হবে? নাকি ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়বে?
উপসংহার
জুলাইয়ের গণহত্যা রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থার চূড়ান্ত ধস। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে, এই রক্তপাতের দায় যাদের, তারা যদি বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়—তাহলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ক্ষমা চাইতে পারব না।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন—আন্তর্জাতিক তদন্ত, দোষীদের শাস্তি, শহীদ পরিবারদের স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ, এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, নতুন এক রাজনৈতিক নৈতিকতার জন্ম। যারা আজ চুপ, ইতিহাস তাদের চুপ করে রাখবে না। কারণ ইতিহাসের পাতায় রক্ত চুপ করে বসে থাকে না—সে চিৎকার করে উঠে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।