সকল মেনু

তিন দ্বীপের এক হয়ে যাওয়া: এক নতুন আখ্যান

দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এখন নতুন জমি এবং সেখানে নতুন বসতি গড়ার এক নতুন আখ্যান তৈরি হচ্ছে। এটি নিছক নদীভাঙা মানুষের গল্প নয়, এটি দেশের ইতিহাসে একটি নতুন ভূমির জন্ম, নতুন অর্থনীতির সম্ভাবনা এবং প্রাকৃতিক-বৈজ্ঞানিক ঘটনাবলির সম্মিলন।

তিন যুগ ধরে সন্দ্বীপ, জাহাইজ্জার চর (বর্তমান স্বর্ণদ্বীপ) ও ভাসানচর—এই তিন দ্বীপ ধীরে ধীরে এক হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) তাদের গবেষণায় এই চিত্র তুলে ধরেছে। নতুন নতুন ভূমির উত্থানের কারণেই এমনটা ঘটছে।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান এ ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যেও এক ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী আশার দিক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ঝুঁকির দিক নিয়ে ক্রমাগত যেসব তথ্য আমরা পাচ্ছি, সেই স্থানে স্পারসোর এই গবেষণা এক ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী বয়ান সৃষ্টি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক পূর্বাভাস বলছে আমাদের ঝুঁকির দিক নিঃসন্দেহে আছে। কিন্তু আমাদের স্থানীয় জ্ঞান বলছে, শুধু ভাঙন নয়, জলমগ্ন হয়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ধ্বংস নয়, আশারও দিক আছে। স্পারসোর এই গবেষণা সেই স্থানীয় জ্ঞানেরই প্রতিফলন।’

বঙ্গোপসাগরের একটি প্রাচীন দ্বীপ হলো সন্দ্বীপ, যা স্পারসোর গবেষণায় তিন হাজার বছরের পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দ্বীপটি বহু বছর ধরেই ক্ষয় ও পলিমাটি জমার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সন্দ্বীপের পাশেই জেগে উঠেছে জাহাইজ্জার চর (বর্তমান স্বর্ণদ্বীপ) ও ভাসানচর।

২০০৬ সালে মেঘনা মোহনার পলিমাটি জমে সৃষ্টি হয় ভাসানচর। এখানে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থানান্তরের জন্য ঘরবাড়ি ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।

স্পারসোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মাহমুদুর রহমান বলেন, এখন সন্দ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপ (জাহাইজ্জার চর) ও ভাসানচর একত্র হয়ে একক ভূমিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি দ্বীপ এখন ভৌগোলিকভাবে প্রায় সংযুক্ত। তবে যেহেতু মেঘনা মোহনার দ্বীপগুলো খুবই পরিবর্তনশীল, তাই নিয়মিত নজরদারি ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ দরকার।

গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় ভৌগোলিক গঠন, বিশেষ করে মেঘনা মোহনার দক্ষিণাংশে দ্বীপের সৃষ্টির ইতিহাস ও বিস্তৃতি ১৯৮৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে অত্যন্ত গতিশীল ছিল। সন্দ্বীপ একটি পুরোনো দ্বীপ হলেও স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসানচর তুলনামূলকভাবে নতুন এবং ক্রমাগত পলিমাটি জমে বিস্তৃত হয়েছে।

গবেষকদের মন্তব্য হলো, কোনো এলাকায় নতুন ভূমি গঠিত হলে সেখানে অন্তত ২০ বছরের আগে মানববসতি গড়ে তোলা যুক্তিযুক্ত নয়। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মো. জাহিদ বলেন, ‘প্রথম দিকে এসব এলাকায় বন তৈরির কথা আমরা বলি। গোচারণ ভূমি হিসেবে অনেক চরভূমি ব্যবহৃত হয়। তবে এসব নদীমধ্যে বা নদীপাড়ে গড়ে ওঠা জনপদ হঠাৎ যে বিলীন হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেখা গেছে, ৫০ বছর পরও কোনো কোনো জনপদ বিলীন হয়ে গেছে।’

তিনি ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে ৫০ বছরের বেশি সময় পরও বিপুল ভাঙন হয়। সন্দ্বীপের আশপাশে যেসব নতুন চরের কথা বলা হচ্ছে, সেসব এলাকায় বসতি করতে হলে হঠাৎ করেই তা করা উচিত নয়। আবার এসব যে দীর্ঘ সময় পরেও বসতের জন্য উপযোগী হবে, তা–ও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। ভাঙা-গড়ার খেলা এ অঞ্চলের একটি বৈশিষ্ট্য, এটা মাথায় রাখতে হবে।

নদী বা সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় নতুন করে ভূমি জেগে উঠলে সেখানে দিয়ারা জরিপ হয়। এটি মূলত নতুন জেগে ওঠা চর বা শিকস্তি-পয়স্তির কারণে ভূমির সীমানা ও স্বত্বের পরিবর্তনের জন্য করা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে ভূমির নকশা ও রেকর্ড প্রস্তুত করা হয়। সন্দ্বীপ বা এর কাছাকাছি এলাকার চরগুলোতে দিয়ারা জরিপের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব এখনো পাঠানো হয়নি বলে জানিয়েছেন সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জুলাই মাসে দায়িত্ব নিয়েছি। আগে জরিপের কোনো প্রস্তাব গিয়েছিল বলে আমার জানা নেই। তবে অবশ্যই জরিপ হওয়া দরকার। আমি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি পেলে প্রস্তাব পাঠাব।’ সন্দ্বীপে এর আগে দেড় বছর ইউএনও ছিলেন রিগ্যান চাকমা। তিনিও কোনো প্রস্তাব পাঠাননি বলে জানান।

শিকস্তি ও পয়স্তি আইন অনুযায়ী, নদীভাঙনে জমি চলে গেলে (শিকস্তি) এবং সেই জমি আবার জেগে উঠলে (পয়স্তি) আগের মালিক জমির মালিকানা ফিরে পাওয়ার অধিকারী হন কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ ও সায়রাত অনুবিভাগ নতুন জেগে ওঠা ভূমির জরিপের বিষয় দেখভাল করে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জরিপ ও সায়রাত অনুবিভাগ) সায়মা ইউনুস জানান, নতুন জেগে ওঠা চরে মাপজোখের পরিকল্পনা এখনো হয়নি।

আইন মেনে নতুন জাগা চরের মালিকানার বণ্টন না হলেও স্থানীয় অনেকেই এসব অঞ্চলে ফিরে আসছেন, জমিজমা চাষাবাদও শুরু করছেন। এই চরে কিছু পরিবার এসেছে। এরা নদীভাঙা মানুষ, আশ্রয়প্রত্যাশী, ভূমিহীন কৃষক। কেউ কেউ কচুরিপানা দিয়ে তুলে ফেলেছেন ‘ঘর’। কেউ কেউ পাকা বাঁশ এনে বেঁধেছেন বেড়া। কেউ কেউ আবার গরু-মুরগির জন্য আগাম ‘খোপ’ তৈরি করছেন। সাধারণত দেশের প্রায় সর্বত্র নতুন জেগে ওঠা জমি নিয়ে সংঘাত দেখা গেলেও সন্দ্বীপ এর ব্যতিক্রম—অন্তত এখন পর্যন্ত।

গত ৩০ বছরে জেগে ওঠা ভূমি নিয়ে কোনো হানাহানির উদাহরণ না থাকলেও মাসখানেক আগে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা চর দখলে নেমে নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছেন। কালাপানিয়া এলাকায় একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা মৌরসি (মূল) মালিকদের হটিয়ে ভূমি দখলে নেমে পড়লে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় সেটি আপাতত থমকে গেছে। তবে জবরদখলের এই চেষ্টা ভূমিমালিকদের মনে এক সংঘাতময় ভবিষ্যতের শঙ্কা তৈরি করেছে। শিকস্তি-পয়স্তি আইন অনুযায়ী, নতুন জেগে ওঠা ভূমি কয়েক বছর পর্যবেক্ষণে রেখে পরবর্তী সময়ে বন্দোবস্ত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের জমির বন্দোবস্ত চলে যায় প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের হাতে।

সন্দ্বীপের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম উপকূল লাগোয়া বিস্তৃত নতুন জেগে ওঠা ভূমিকে স্থানীয় লোকজন প্রকৃতির আশীর্বাদ বলেই মনে করছেন। সন্দ্বীপ এমন একটি এলাকা, যেখানে সাগরগর্ভে ভিটেমাটি হারানোর স্মৃতি প্রায় প্রতিটি পরিবারের আছে। লাখো মানুষের স্মৃতিতে এসব ভূমি তাঁদের পূর্বপুরুষের ঠিকানা ফিরে পাওয়ার এক অসাধারণ অনুভূতি জাগায়।

নদীর ভাঙা-গড়ার খেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পলল গঠিত বাংলাদেশের এই দক্ষিণ প্রান্তের ভূমি জেগে ওঠাকে ‘নতুন কৃষিজগতের’ উত্থান বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নতুন এই জগৎ শুধু পলি নয়, তা যেন একটি জাতীয় প্রশ্নপত্র। আমরা কীভাবে আমাদের নদী, ভূমি ও মানুষকে মূল্য দিই, সে বিষয়ে প্রশ্নপত্র। সঠিক জাতীয় নীতিমালা ছাড়া এই নতুন সম্ভাবনাও শোষণের গল্প হয়ে যেতে পারে। এ জগৎ আমাদের নীতি, বিজ্ঞান, কল্পনা ও সাহসিকতার পরীক্ষা। যদি আমরা সঠিকভাবে এর দিকে তাকাই, তবে হয়তো অজস্র মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

TOP